কতরাত যে কেঁদেছি তার একমাত্র সাক্ষী উপরের আল্লাহ আর আমার বিছানার বালিশ

তখন ২০১২ সাল এসএসসি পাশ করে বরিশালে একটি কলেজে পড়ার সুযোগ পেলাম। খুব আগ্রহ মনের মধ্যে, কবে যাব মেসে উঠবো নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হবো ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা প্রথম প্রথম দ্বিমত ছিল শহুরে পরিবেশ, বয়স কম, টাকা পয়সার ব্যাপার কিন্তু আমি তো আমার সিদ্ধান্তে অনড়, বাবা আমি ঐখানেই পড়বো [মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন দেখতে বারণ আমি তখন বুজিনা]। ছেলের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে বাবা বললো ঠিক আছে। 


অক্টোবরের ১৩ তারিখ কলেজে যেতে হবে ফোনে এসএমএস আসলো। বাবা-মাকে দেখালাম, মা বললো ঐখানে গিয়ে আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি কষ্ট হবে না ? আমি তো এক কথায় উত্তর দিলাম "না"। আমি তখনও বুজতাম না, বরিশালে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি আমাকে পরিবার থেকে দূরে সরাচ্ছে। পরেরদিন বাবা বাজারে গিয়ে আমার জন্য প্রয়োজনীয় মশারী, বিছানার কাপড়, ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে আসলো। মা এইসব দেখছে আর চোখ দিয়ে পানি ফেলছে কিন্তু আমি কাছে গেলে বুজতে দিচ্ছে না। এই ভাবেই চলে আসলো অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ। বাবা এবং আমি বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম বাড়ির সবাই আমাকে এগিয়ে দিতে বাড়ি থেকে অনেক দূর আসলো আর মা যেন পিছুই ছাড়ছেন না। আমি মাকে বলি মা তুমি বাড়ি যাও আমি তো কয়েকদিন পরেই চলে আসবো। মা পথের কোনে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। বাবা বারবার বলতে ছিল থাকতে পারবি তো আমি বলি হ্যা। বাবার সাথে কথা বলতে বলতে লঞ্চঘাট চলে আসলাম। 


লঞ্চ থেকে যখন বরিশাল শহরে পা রাখলাম তখন দুপুর ১:১৫ মিনিট। বাবা আর আমি হোটেলে খেয়ে মেসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম [এলাকার একটা বড় ভাইয়া বরিশালে পড়তেন উনি মেস ঠিক করে রেখেছিলেন] । মেসের সামনে এসে বাবা ওই ভাইয়াকে ফোন দিলে সে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলো। মেস কি বুজতাম না এখানে এসে দেখি ছোট্ট ছোট্ট রুম (এইগুলোকেই বুজি শহরে মেস বলে) । মেসে সবার সাথে পরিচয় বিনিময় করলাম। আমার জন্য একটা সিট্ বরাদ্দ হলো ঐখানে আমার জিনিসপত্র বাবা আর আমি গুছিয়ে রাখলাম। বাবা বললো তাহলে তুমি থাকো আমি এবার বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হচ্ছি, আমি বাবার সাথে সামনে আসলাম বাবা চলে যাচ্ছে আর বারবার পিছনের দিকে তাকাচ্ছে। বাবা যখন দৃষ্টির আড়াল হলো আমি ভিতরে চলে আসলাম। সবাই যে যার মত কেউ পড়ছে, কেউ এফএম রেডিও শুনছে, কেউ শুয়ে আছে। আমার মনে হলো আমি কি করবো, আমি বিছানায় চুপটি করে বসে থাকলাম। 


সন্ধ্যা হয়ে আসলো মনটাও খারাপ হতে লাগলো বাড়ির কথা মনে পড়ছে। একজন ভাইয়া এসে বললো চলো বাহির থেকে ঘুরে আসি, আমি মন খারাপ করে বসে আছি উনি বুজতে পেরে জোর করে নিয়ে গেলো। বাহিরে বের হয়ে খুব ভালোই লাগছিলো অনেক মানুষ, দোকানপাট খোলা যেখানে আমাদের গ্রামে সন্ধ্যা হতেই সব বন্ধ থাকে। আমি ভাইয়াকে বললাম আমাকে আমার কলেজটি চিনিয়ে দিবেন উনি বললেন চলো।আমরা কলেজে গেলাম উনি আসার পথে আমাকে শর্টকার্ট রাস্তাও দেখালেন বললেন এই রাস্তা ব্যবহার করে তুমি তাড়াতাড়ি আসতে পারবে। ওই রাস্তা ধরে দুইজন বাসায় চলে আসলাম। 


মেসে সবাই যে যার মত খাচ্ছে আমাকে কেউ ডাকছে না। একজন বলে খাচ্ছনা কেন ? এসো আমার সাথে, এখানে সবকিছু থাকে, খালা দুই বেলা রান্না করে দিয়ে যায়, প্রয়োজনমত সময় করে খাবে। আমি মাথা নেড়ে হ্যা সূচক উত্তর দিলাম। খাবার শেষে সবাই ঘুমের জন্য প্রুস্তুতি নিচ্ছিলাম। বিছানা গোছাতে গিয়ে বারবার মায়ের কথা মনে পড়ছিলো [আমি বাবা-মায়ের সাথেই ঘুমাতাম]।মেসের অন্য সদস্যরাও বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়লো। রুমের আলো নিভাতেই আমার চোখ বেয়ে জল পরা শুরু হলো। শব্দ করে কান্নাও করতে পারছি না অন্যরা কি ভাববে।দৌড়ে চলে গেলাম ওয়াশরুমে, ঐখানে দাঁড়িয়ে কতক্ষন চোখের জল ফেললাম। কেউ একজন দড়জায় টোকা দিতে চোখে মুখে পানি দিয়ে বের হয়ে আসলাম। মায়ের কথা খুব মনে পরছে। মনে পরতে ছিল আসার সময় এগিয়ে দেয়ার মূহুর্ত, আমাকে এখানে রেখে বাবার চলে যাওয়ার মুহূর্ত। এইভাবে কতরাত যে কেঁদেছি তার একমাত্র সাক্ষী উপরের ওই আল্লাহ আর আমার বিছানার বালিশ। 



 পার্ট-১

কৃতার্থে : ইমবা    


Post a Comment

1 Comments

  1. দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে শহুরে পাড়ি জমানো হাজারো গ্রামীণ কিশোরের গল্প এটা।আমিও তার সাক্ষী।।

    ReplyDelete